Title Title

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যা

সমীক্ষা বিশ্লেষণ

লেখক: ড. এসইউ আশরাফী ও প্রধান স্বেচ্ছাসেবী সমন্বয়ক- ভয়েস অফ বয়কট

পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশ ‘সীমান্ত বন্ধ’ হওয়ার নীতি অনুসরন করে। বর্তমান সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত উন্মুক্ত হওয়ায় হাজারো সমস্যা দেশ দুটোকে সমস্যা আকীর্ন করে তুলছে। ১৯৭২-২০২০ পর্যন্ত বাংলোদেশ ভারত সীমান্তে ১৮৬০ নিহত হয়েছে এবং অপহরণ, ধর্ষণ ও নিখোঁজ সংখ্যাসহ সর্বমোট ৫০৮৪ জন বাংলাদেশি নাগরিক বিভিষিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বর্তমান গবেষণায় ২০১৪-২০১৬ সময়ে সীমান্তে নাগরিক হত্যা বিষয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। এ সময়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ও শারীরিক নির্যাতনে ৫৭ বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। অপহরণের শিকার হয়েছেন ৮৭ জন। অপহরণের পর ফিরে আসতে পেরেছেন ২৭ জন। এছাড়া গুলি ও নির্যাতনে আহত হয়েছেন শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিক। হত্যার ঘটনাগুলোতে বরাবরের ন্যায় বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে গরু পাচারের অভিযোগ তুলেছে বিএসএফ। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও অধিকারের প্রতিবেদন, ভারতীয় পত্রিকা দ্য হিন্দু’র প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনী বিজিবির পিলখানাস্থ সদর দফতরে আয়োজিত ‘সীমান্ত সম্মেলন-২০১৭’ এ সীমান্ত হত্যার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছিল বিজিবি। তবে ২০১৪-২০১৬ চিত্রে এর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি বরং বেড়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মানবাধিকার সংগঠকদের মতে, বিএসএফের কারণেই হচ্ছে সীমান্ত হত্যা। দুদদেশের মধ্যে সমঝোতা এবং এ সম্পর্কিত চুক্তি অনুযায়ী যদি কোন দেশের নাগরিক অনুনোমোদিতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে, তবে তা অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত হবার কথা এবং সেই মোতাবেক ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের নিয়ম। তবে এই সমঝোতা এবং চুক্তি লঙ্ঘন করে বিএসএফ সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করছে ও অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের হুমকি স্বরূপ। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর বিগত ৩৬ মাসের ২০১৪-২০১৬ তথ্যানুযায়ী ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে ৯৩ বাংলাদেশি নাগরিককে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৭, খুলনায় ১১, রাজশাহী ৭ এবং রংপুরে ১২ জন শুধু ২০১৫ সালে। বিএসএফের শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ১২ বাংলাদেশি। এরমধ্যে খুনলায় ৪, রাজশাহী ৭ ও রংপুর ১ জন। আসকের তথ্যানুযায়ী, গত ১১ মাসে বিএসএফ কর্তৃক শারীরিক নির্যাতন ও গুলিতে আহত হয়েছেন ৬৪ জন। এরমধ্যে ঢাকায় ১, খুলনায় ১৯, রাজশাহী ১৭ ও রংপুরে ২৭ জন। বিএসএফ কর্তৃক অপহরণের শিকার হয়েছেন ৫৬ বাংলাদেশি নর-নারী। এরমধ্যে ঢাকায় ৮ জন, খুলনায় ১১, রাজশাহী ৫ ও রংপুরে ২৫ জন। এছাড়া অপহরণের পর ফিরে আসতে পেরেছেন মাত্র ২৪ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মতে গুলি চালিয়ে, নির্যাতনে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার সংখ্যা আরও বেশি। অধিকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে ২৮ বাংলাদেশি নাগরিককে। এরমধ্যে গুলিতে ১৭ জন, শারীরিক নির্যাতনে ৯ জন এবং এছাড়া একজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে গলা কেটে হত্যা করে বিএসএফ। এই সময়ে আহত হয়েছেন ৪০ জন। গুলিতে ২৮ জন আহত হয়েছেন, শারীরিক নির্যাতনে ৮ জন, এবং তীর ও গুলতির আঘাতে আহত হয়েছেন বাকিরা। এছাড়া ২০ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বিএসএফ। এছাড়ও মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) গত জুন মাসে টেকনাফের নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে। এক বিজিবি সদস্যকে গুলি করে আহত করে এবং অপর এক সদস্যকে ধরে নিয়ে যায়। অন্যদিকে, ভারতীয় পত্রিকা দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে গরু পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাঠানো বন্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। এই সময় সীমান্তে ২৪ জন মারা গেছেন। ত্রিকারটির প্রতিবেদনে এক বিএসএফ কর্মকর্তার উদ্বৃতি দিয়ে দাবি করা হয়েছে, গরু ‘পাচারকারী’ নিহত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত দুই পাশেই হয়েছে। আবারো বাংলাদেশ সীমান্ত বাহিনীর পিলখানাস্থ সদর দফতরে আগামী ২২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে সীমান্ত সম্মেলন। এবারও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এর সীমান্ত সম্মেলনে আলোচনার শীর্ষে অন্যান্য ইস্যুর সঙ্গে গুরুত্ব পাবে সীমান্ত হত্যার বিষয়টি। গত ৬ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর ঢাকার পিলখানাস্থ বিজিবি সদর দফতরে সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এতথ্য জানান মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। তিনি বলেন, মানবাধিকার সংগঠক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা যে পরিসংখ্যান দিচ্ছেন তা পুরোপুরি সঠিক না। আমাদের দেশের লোকজন অনুনোমোদিতভাবে রাতের বেলা বর্ডার পাড় হয়ে ভারত সীমান্তে ঢুকে। গরু আনতে যায়। বিএসএফও দাবি করে যে তাদের উপর হামলা করা হচ্ছে। বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ ও গরুর চাহিদা দেশেই পূরণে বাংলাদেশে ক্যাটল ফার্মিংকে (গরু খামার) উৎসাহিত করা উচিত। তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকেই সীমান্ত হত্যা বন্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে বিজিবি ও বিএসএফ যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু এরপরও বন্ধ হচ্ছে না সীমান্ত হত্যা। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে গরু উৎপাদন বাড়লে নতুন বাজার ও চাহিদা দেশ থেকেই পূরণ হবে। পাশাপাশি গরুর জন্য আর ভারতের উপর আমাদের নির্ভর করতে হবে না। এতে করে সীমান্ত হত্যাও বন্ধ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ১৭ ফেব্রæয়ারী ২০১৪ সাতক্ষীরা সীমান্তে ২ জন, সিলেট সীমান্তে ফুরকান ও নান্নু মিয়া নামক ২ জন, একই তারিখে বিয়ানী বাজার সীমান্তে ২ জন; ২৪ ফেব্রæয়ারী বিরামপুরে মমতাজ (২১); ২৭ ফেব্রæয়ারী দিনাজপুর সীমান্তে ২ জন; ৬ মার্চ তেতুলিয়ায় সামছুদ্দিন (৩০); ১৩ মার্চ নওগাঁ ও মহেশপুরে বারিক ও ওয়াকার নামক দুই কিশোর; ২১ মার্চ সাতক্ষীরা সীমান্তে বকুল হোসেন (১৮) ও সুলতান হোসেন; ৬ এপ্রিল কুড়িগ্রাম ইব্রাহীম (২৫); ৯ এপ্রিল দিনাজপুরে কাছিম উদ্দিন; ২১ এপ্রিল ঝিনাইদহে আবদুল খালেক (২৮); ৩ মে চাঁপাই সীমান্তে আমিরুল ইসলাম (৩০); ৫ মে বেনাপোল সীমান্তে মধুমিয়া (২৫); ২৪ এপ্রিল ঝিনাইদহে হারুন অর রশীদ (২২); ২৯ এপ্রিল নওগাঁয় ২ জন; ১২ জুন রুদ্রপুরে সাইদুর রহমান (২৮); ১৩ জুন বিরামপুরে মজিবুর রহমান (৩০); ১৮ জুন বুড়িমারিতে সেলিম মিয়া (৩৫); ২৮ জুন ছাগলনাইয়ায় বাহার (৩৫); ৬ জুলাই সাতক্ষীরায় মফিজুল (২৪); ৯ জুলাই শার্শায় সবুজ (২২), আহমদ (২০), আরিফুল ইসলাম (২৫) ও আবদুস সালাম (২২); ১১ জুলাই চাঁপাই-এ জমিরুল ইসলাম (২৪); ১২ জুলাই বিরামপুরে ২ জন; ৭ জুলাই পাঁচ বিবিতে হামিদ মন্ডল (৩২); ৩০ জুলাই চুয়াডাঙ্গায় মিজান (২২); ৪ অগাস্ট চাঁপাই-এ মতিউর রহমান (২৫), সুবেদ আলী (২৭); ৭ জুলাই বুড়িমারিতে ১ জন; ৯ অগাস্ট যশোরের অগ্রভুলট সীমান্তে সবুজ (২২), আহমদ (২২), আরিফুল (২৫), আবদুল মান্নান (২২); ২৬ আগস্ট বেনাপোলে এরশাদ আলী (৩২); ৯ সেপ্টেম্বর চাঁপাইয়ে মনির হোসেন (২৪), ১৪ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর সীমান্তে ২ জন ও ১৭ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর সীমান্তে ৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৬ নভেম্বর কুড়িগ্রামে ছাগল খুঁজতে গিয়ে এক কিশোরী বিএসএফ’র হাতে নিহত হয়। ৬ অকটোবর সাতক্ষীরা বকচরা নদীতে মাছ ধরার সময় বিএসএফের স্পিড বোটের ধাক্কায় আনোয়ার নামের এক বাংলাদেশী নিহত হয়। ইচ্ছে করেই বিএসএফের স্পিড বোড এ ধাক্কা দেয়। দৈনিক কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায় ২০১৪ সালে বিএসএফ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তে ৮৯ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। সবচেয়ে বেশি সাতক্ষীরা সীমান্তে ২২ জন, যশোর সীমান্তে ১৬ জন, ঝিনাইদহ সীমান্তে ৭ জন এবং চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানিয়েছে ২০১৫ সালে বিএসএফ ৯৬ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে, বিএসএফ’র হাতে আহত হয়েছে ৭৯ জন। এছাড়া ২৫ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। ৯২ জন নিখোঁজ রয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারী ও ফেব্রæয়ারি মাসে বিএসএফ’র গুলিতে মারা যায় ১৫ জন। গত ১৪ ফেব্রæয়ারি ২০১৫ সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজহাট ইউনিয়নের ডিবির হাওর এলাকা থেকে বিডিআর নায়েক মুজিবুর রহমানকে গুলি করে ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ। ১৭ ফেব্রæয়ারি তামাবিল সীমান্তে বিএসএফ ও বিডিআর’র মধ্যকার পতাকা বৈঠকের পর বিএসএফ সদস্যরা নায়েক মুজিবরকে ফেরত দেয়। এছাড়া গত ২৬ ও ২৮ ফেব্রæয়ারি ২০১৫ বিএসএফ সদস্যরা একই সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ করে বাংলাদেশী নাগরিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ২০১৫ সালে সীমান্তে অন্তত ৬টি স্থানে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বিএসএফ। জানুয়ারি-জুন ২০১৫ এ ৬ মাসে ৩৫ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জনকে পিটিয়ে ও ২৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া বিএসএফ একই সময়ে ৪১ জনকে আহত করেছে। ৫ জুলাই ২০১৫ সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুর সীমান্তে বিএসএফ’র ছত্রছায়ায় ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে ৫ বাংলাদেশী কৃষক আহত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইউরোনিয়ামসহ দুর্লভ ও মূল্যবান বেশ কিছু খনিজ সম্পদ আবিস্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় বিএসএফ সিলেটের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্নভাবে আগ্রাসন চালাচ্ছে। ২০১৫ সালের প্রথম ৬ মাসে সিলেট সীমান্তে সবচেয়ে অধিক সংখ্যক গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২১ অক্টোবর ২০১৬ কুষ্টিয়া সীমান্ত থেকে ৫ জন বাংলাদেশীকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ। ১৬ অক্টোবর ২০১৬ বিএসএফ’র হত্যাকান্ডের শিকার হয় ৩ জন। নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের সন্ন্যাসী পাড়া গ্রামের জসিম উদ্দিন নামে এক বাংলাদেশী কৃষক বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হন। ফসলের জমি দেখতে গেলে বিএসএফ তাকে গুলি করে হত্যা করে। একই দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শিংনগর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে খুন হন বাংলাদেশী নাগরিক আবদুল লতিফ এবং পঞ্চগড় সীমান্তে ভারতীয় হায়েনাদের হাতে নিহত হন এক বাংলাদেশী নাগরিক। এর আগে ৫ অক্টোবর ২০১৬ শেরপুরের নালিতাবাড়ী সীমান্তে সাধন ঘোষ নামে অপর এক বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় পুলিশ। ঘটনার তিন দিন পর তার লাশ হস্তান্তর করা হয়। ১২ অক্টোবর লালমনিরহাট সদর উপজেলার দুর্গাপুর সীমান্তে এক বাংলাদেশীর লাশ উদ্ধার করা হয়। বিএসএফ তাকে হত্যা করে রাতের অন্ধকারে লাশ ফেলে যায়। ১৮ অক্টোবর ২০১৬ কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ সীমান্ত থেকে ফারুক মিয়া, আশিক, ফারুক, সুমন আলী ও সুমন নামে ৫ নাগরিককে ধরে গেছে বিএসএফ। তাদের বাড়ি রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের মুন্সীগঞ্জ ভাঙ্গাপাড়া গ্রামে। গরুর জন্য খাবারের ঘাস কাটতে গেলে ভারতের নদিয়া জেলার হোলবাড়িয়া থানার কৃষাণ ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্যরা তাদেরকে আটক করে নিজ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ১২ ডিসেম্বর ২০১৬ বিএসএফ সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের ইসমাইলের পুত্র কবিরুল ইসলাম (৩৪) কে কলারোয়া সীমান্তে গুলি করে হত্যা করে। ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ রাজশাহীর খানপুর সীমান্তে বিএসএফ’র নির্যাতনে এক গরু ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত তিন বছরে বিএসএফ’র হাতে ৮৬ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। একই সময়ে আহত হয়েছেন ১৬৮ জন এবং ১২৭ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। ১৭ ফেব্রæয়ারি ২০১৬ ভোররাতে বেনাপোলের পুটখালি সীমান্তে বাংলাদেশী ব্যবসায়ী ইসরাফিলকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিএসএফ। ২০১৪ সালের ফেব্রæয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বিএসএফ’র গুলিতে ও শারীরিক নির্যাতনে মরা গেছে ২৩ জন বাংলাদেশী। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সীমান্তে ১৯ জন, যশোর সীমান্তে ২৫ জন, ঝিনাইদহে ৮ জন ও চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে ৪ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ২৯ জনকে গুলি করে এবং ৩৪ জনকে শারীরিক নির্যাতন ও বিদ্যুতের শক দিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া প্রায় দুই শতাধিক মানুষকে গুলি ও নির্যাতন চালিয়ে আহত করা হয়েছে। ভারতের কাঁটাতারের বেড়ায় নিরীহ ফেলানীর লাশ নয়, ঝুলছে বাংলাদেশ এই শিরোনামে দৈনিক কালেরকন্ঠ (২০১৬) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাবা-মায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তান মারা যাওয়ার পর ১৫ বছর আগে জন্ম নেয়া এই শিশুটি যাতে বেঁচে থাকে, সে আশা নিয়েই তার নাম রাখা হয়েছিল ফেলানী। বধূ বেশে স্বামীর ঘরে যাওয়ার মতো করে মেয়েকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়েছিলেন মা জাহানারা বেগম। চারচালা টিনের ভাঙা বেড়ার ঘরে বসে সেই স্মৃতিই রোমন্থন করছিলেন মা জাহানারা বেগম। বলছিলেন, সঞ্চয় যা ছিল সব দিয়ে সোনা রূপার গয়নাও পরিয়ে দিয়েছিলাম ওকে। কিন্তু তার মেয়ে লাশ হয়ে ফিরেছে নিজের ঘরে। গত ৭ জানুয়ারী ২০১১ প্রত্যুষে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তের দক্ষিণ অনন্তপুর হাজিটারী গ্রামের ৯৪৭/৩ এস আন্তর্জাতিক পিলারের কাছে ভারতীয় অভ্যন্তরের খেতাবেরকুটি এলাকায় নির্মমভাবে ঠান্ডামাথায় গুলি করে ফেলানীকে হত্যা করে বিএসএফ। ভারতের কুচবিহার জেলার দিনহাটা থানার চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফরা এই হত্যায় জড়িত ছিল। ২০১৪-২০১৬ সালে বিচারহীনতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার সীমান্ত হত্যার মুখ্য কারণ উল্লেখ করে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। গরু চোরাচালানের সময় বিএসএফ এর গুলিতে প্রাণ হারনোর খবর প্রায়ই দেখি কিন্তু ফেনসিডিল বা অন্যকোন পণ্য চোরাচালানের সময় এরকম কোন ঘটনার কথা কখনও শোনা যায় না। আবার গরু চোরাচালান প্রতিদিনই হয় কিন্তু গুলি প্রতিদিন হয় না। তাহলে যখন গুলি হয় তখন কেন হয় আর যখন হয় না তখন কেন হয় না, কেন ফেনসিডিল, সাইকেল, মসলা, কাপড় ইত্যাদি পণ্য বাদ দিয়ে শুধু গরু চোরাকারবারির সাথে যুক্ত, তাও আবার যারা কেবল বাংলাদেশের নাগরিক, সেই মানুষগুলোই সময় সময় বিভিন্ন সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে প্রাণ হারায়, নির্যাতিত হয়। এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের সন্ধানে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, ঠাকুরগাও, পঞ্চগড়ের বিরামপুর, ফুলবাড়ি, হরিপুর, মাড়েয়া, বেরুবাড়ি, তেতুলিয়া সংলগ্ন বিভিন্ন সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষ, গরু-ফেন্সিডিল চোরাকারবারী, মহাজন, লাইনম্যান, গরুর পাইকার, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চোরাচালানের একটি অন্যতম রুট। মাদক চোরাচালানের জন্যে ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল এই রোডকে ‘গোল্ডেন ওয়েজ’ বলা হয়। মাদক থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণের চোরাচালান হয়ে থাকে এ পথে। আন্তজার্তিক চোরাচালানের পেছনে এই রুটে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চক্র সক্রিয় রয়েছে। এসব চক্র মূলত ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক এবং অস্ত্রের চোরাচালান করে থাকে। এ ধরনের বড় বড় চোরাচালানের পেছনে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেরই সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং প্রশাসনের যোগসূত্র রয়েছে। ফলে বড় চোরাচালানের ঘটনায় সীমান্ত হতাহত হয় না। কিন্তু সীমান্ত অতিক্রম করে যেসব চোরাচালান হয়ে থাকে সেসব ঘটনায় প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সমস্যা  নাগরিক হত্যা সমীক্ষা (২০১৪-২০১৬) পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য দ্বি-পাক্ষিক সমঝোতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সীমান্তে কাঁটা তারের বদলে রেড রে প্রযুক্তি ব্যবহার, নারী সীমান্তরক্ষীর পাহারা বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


রেফারেন্স

গ্রন্থপঞ্জি

  1. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম (২০১৬) বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সন্ত্রাস, পাঠাগার প্রকাশনী: ঢাকা।
  2. জিন্নাহ, আশিকুল ইসলাম (২০১৫), বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ভারত-বাংলাদেশ, চমনপ্রকাশ, ঢাকা।
  3. মাননান, মুনশী আব্দুল্লাহ (২০০৬), ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, ঝিনুক প্রকাশ, ঢাকা।
  4. গেইল তুহিন (২০১৬), আতঙ্কের দেয়ালঃ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত, অনুবাদ: অসিত রায়, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।
  5. পারভেজ মাহফুজ, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরণ, মোশারফ হোসেন খান সম্পাদিত সেমিনার স্মারক- গ্রন্থ (২০০৮), বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা।
  6. হোসেনুর রহমান (২০০৭), ভারত বাংলাদেশ ২০০০, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স (প্রা.) লিমিটেড, কলকাতা।

সংবাদপত্র ও সাপ্তাহিক পত্রিকা:

  1. ইমদাদুল হক মিলন (২০১৫) এখন স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পালা, নির্বাহী সম্পাদক : মোস্তফা কামাল। দৈনিক কালের কন্ঠ।
  2. আবু সাইদ বিশ্বাস (২০১৭), গরু প্রতি চাঁদা আদায় করা হচ্ছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা, দৈনিক সংগ্রাম।
  3. মোহাম্মাদ আব্দুর রব (২০০৪), বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসনঃ বিপন্ন সার্বভৌমত।
  4. শাহাদাত হোসেন (২০১৫), সীমান্তে বিএসএফ’র নির্যাতনঃ মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, দৈনিক ইনকিলাম (১৮ ফেব্রæয়ারী ২০১৫)
  5. বেলায়েত হোসেন (২০১৪), সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ও নিরীহ মানুষ হত্যা, দৈনিক যুগান্তর।
  6. মাহমদুল হাসান, সম্পাদকীয় (২০১৫), সীমান্তে হত্যা: বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব, দৈনিক পুর্ব বাংলা।
  7. হাসিম মামুন (২০১৬), ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সমস্যা ও নিরাসন, মানবজমিন, ১৯ ডিসেম্বর।
  8. এমএম খালেদ সাইফুল্লাহ (২০১৫), সীমান্ত হত্যা এবং বন্ধুরাষ্ট্র সংজ্ঞা, দৈনিক ইনকিলাব, ২০ জানুয়ারি ২০১৬।
  9. কামাল আহমেদ (২০১৩), বশ্বিায়নরে কাল: বশ্বিরে সবচযে়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত, দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ সেপ্টেম্বর।
  10. সাপ্তাহিক ২০০০, প্রচ্ছদ প্রতিবেদন, ১৩ জানুয়ারি ২০১১।
  11. আড়াই বছর পরে শুরু হল বিচার, আনন্দ বাজার পত্রিকা, ২১ জুন, ২০১৫।
  12. ভারত ও পাকস্তিান সীমান্ত সমস্যা, কারন্টে অ্যাফেয়ার্স, মার্চ ২০১২।
  13. ডয়েচে ভেলে (২০১৬), বাংলাদেশিদের সঙ্গে শত্রæর মতো আচরণ করছে ভারত, মাসিক সংস্করণ, ১৫ ফেব্রæয়ারি।

জার্নাল ও প্রবন্ধ:

  1. ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সমম্মেলন শুরু শনিবার, বাংলা ট্রিবিউন, ১৭ আগস্ট, ২০১৭
  2. ড. মো: মাহবুবর রহমান (২০১১), বাংলাদেশের ইতিহাস, সময় প্রকাশন: ঢাকা।
  3. বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন:
  4. বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) প্রতিবেদন, ২০১৬
  5. আইন ও সালিশ কেন্দ্র (অঝক), সীমান্ত সহিংসতা, ২০১৬।
  6. বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) প্রতিবেদন, ২০১৫
  7. বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ), বাৎসরিক প্রতিবেদন-২০১৬
  8. হিউম্যার রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদন, ২০১৬
  9. ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইভি), ২০১৫
  10. বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন, ২০১৫
  11. হিন্দুস্থান টাইমস (বাৎসরিক প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ), ২০১৪


Title