Title Title

ইসরায়েলি পণ্য বয়কট করা ইসলামী শরিয়াহ্ দৃষ্টিতে অত্যাবশ্যক

আইন

কোনো গোষ্ঠী যখন ইসলাম, ধর্মীয়গ্রন্থ কোরআন, মহানবী মুহাম্মদ (ﷺ) অথবা ইসলামের অন্য বিষয়গুলোর প্রতি অবমাননা করে কিংবা মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায়, তখন বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা ওই গোষ্ঠী এবং তাদের সহযোগীদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার অথবা তাদের পণ্য বর্জন করার আহ্বান জানান। তবে ইসলামে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য অনুমোদিত হওয়ায়, কিছু লোকের মতে, ইসলামি শাস্ত্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক বয়কটের কোনো সম্পর্ক নেই; এটি ইসলামের মূলনীতির বিরুদ্ধে।

ইসলামে সাধারণ কাফেরদের সাথে বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য জায়েজ। তবে যে কাফের গোষ্ঠী মুসলমানদের ওপর জুলুম করে, ইসলামবিরোধী কার্যক্রম চালায়-তাদেরকে সমর্থন বা সহযোগিতা করা কখনোই জায়েজ নয়।

 আল-কুরআনে বলা হয়েছে, لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ তুমি এমন কোনো কওম পাবে না, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, অথচ আল্লাহ ও তার রসুলের বিরোধিতা করাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে (সুরা মুজাদালা: ২২)

ইসলামে অমুসলিমদের সঙ্গে (স্বদেশী বা বিদেশী) সব ধরনের বৈধ বেচাকেনা অনুমোদিত। রাসুল (ﷺ) মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে ব্যবসা করতেন, এবং এমনকি একবার এক পৌত্তলিক বণিকের কাছ থেকে ছাগলও কিনেছিলেন (বুখারি ও মুসলিম)। তবে যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধের সরঞ্জাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত বস্তু অমুসলিমদের কাছে বিক্রি করা হারাম। ইমাম নববি (رحمة الله عليه) বলেছেন, ‘কাফিরদের সঙ্গে সব ধরনের বৈধ বেচাকেনা সর্বসম্মতিক্রমে জায়েজ, তবে যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জাম এবং তাদের ধর্ম প্রচারে সহায়তা করে এমন পণ্য বিক্রি করা জায়েজ নয়’ (শরহে সহিহ মুসলিম)। আল মাজমু গ্রন্থে তিনি এটিকে সকল ফকিহদের সর্বসম্মত মত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

এই মাসআলা থেকে ইসলামী শরিয়তের একটি মৌলিক নীতি স্পষ্ট হয়: যে সমস্ত ব্যবসায়িক লেনদেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফির গোষ্ঠীকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে, তা জায়েজ নয়। সুতরাং, যেসব কোম্পানি ইসলামবিরোধী কার্যক্রমে অর্থ সরবরাহ করে বা মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাতে সহায়তা করে, তাদের পণ্য বর্জন করা শুধু বৈধই নয়, তা মুসলমানদের ইমানের জন্যও জরুরি হতে পারে। ইবনুল কাইয়িম (رحمة الله عليه) বলেন, ‘যে কোনো পদক্ষেপ যা মুসলমানদের উপকারে আসে, ইসলামে আগত যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করে, মজলুম ও বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করে এবং সত্যবিরোধী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে, তা উত্তম ও উপকারী’ (ইগাসাতুল লাহফান)

 মাওলানা আশরাফ আলি থানভি (رحمة الله عليه) বলেন, `বয়কট এবং অসহযোগ আন্দোলন মৌলিকভাবে যুদ্ধ নয়, তবে এটি শত্রুকে দুর্বল করার একটি কৌশল, যা মুবাহ তথা বৈধ’ (হাকিমুল উম্মত কি সিয়াসি আফকার)। মাওলানা জফর আহমদ উসমানি (রহ.) বলেন, `যদি কোনো বৃহৎ স্বার্থে শত্রুরাষ্ট্রের পণ্য ছেড়ে দেশি পণ্য ব্যবহার করা হয়, তবে তা বৈধ এবং এমনটি করা উত্তম’ (ইমদাদুল আহকাম)। আরব আলিমদের মধ্যে শায়েখ আবদুর রহমান ইবনে নাসির আস-সাদি (رحمة الله عليه), শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানি (رحمة الله عليه), আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে জিবরিন, ইউসুফ আল-কারজাভি (رحمة الله عليه) সহ আরও অনেকে এই মতামত দিয়েছেন (আল-মুকালামাতুল ইকতিসাদিয়্যাহ)

ইসলামের ইতিহাসে বাণিজ্যিক বয়কটের একাধিক ঘটনা পাওয়া যায়, যা শত্রুপক্ষকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো:

প্রথমত, সহিহ বুখারিতে একটি দীর্ঘ হাদিস রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, এক অভিযানে ইয়ামামাবাসী সর্দার সুমামা ইবনে উসাল (رضي الله عنه)-কে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং কিছু দিন পর রাসুল (ﷺ) তাঁকে মুক্তি দেন। ইসলাম গ্রহণের পর, সুমামা (رضي الله عنه) মক্কায় গিয়ে মক্কার কাফিরদের দ্বারা উত্ত্যক্ত হন, তখন তিনি বলেন, `আল্লাহর কসম, যতক্ষণ না নবী (ﷺ) অনুমতি দেন, ইয়ামামা থেকে একটি শস্যদানা মক্কায় আসবে না।‘ এরপর তিনি মক্কায় শস্য রপ্তানি বন্ধ করে দেন। এতে মক্কাবাসী চরম দুর্ভোগে পড়ে। অবশেষে তারা রাসুল (ﷺ)-এর কাছে অনুরোধ জানালে, তিনি সুমামাকে বয়কট তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন।

দ্বিতীয়ত, খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের যুগে রোম থেকে দিনার-দিরহাম আমদানি করা হতো, এবং মুসলমানরা এর বিনিময়ে কাগজ রপ্তানি করত। রোম সম্রাট একবার মুসলমানদের পাঠানো কাগজের লেখাটি দেখে ক্ষুব্ধ হন, কারণ তারা ঈসা (عليها السلام)-কে আল্লাহর পুত্র হিসেবে ধারণা করতেন। তখন তিনি খলিফার কাছে চিঠি লেখেন, ‘যদি এই লেখা না পরিবর্তন করা হয়, তাহলে আমি আপনাদের নবীর ব্যাপারে অপমানজনক কিছু লিখে দেব।’ খলিফা তখন চিন্তিত হয়ে বলেন, ‘নিজেই দিনার বানানো শুরু করো এবং রোমে কাগজ রপ্তানি বন্ধ করে দাও।’ খলিফা সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন (বুগইয়াতুত তলব ফি তারিখি হালাব)। এই দুটি ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে ইসলামের ইতিহাসে অর্থনৈতিক বয়কটের কার্যকরী ব্যবহার এবং শত্রুকে দুর্বল করার জন্য এর বৈধতা রয়েছে।

 বিশ্বের সব মুসলিম ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জিহাদ করার আহ্বান জানিয়ে একটি বিরল ধর্মীয় ফরমান বা ফতোয়া জারি করেছেন বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিত। অবরুদ্ধ গাজার বাসিন্দাদের ওপর ১৭ মাস ধরে চলা নৃশংস ও নির্বিচার ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় গতকাল তাঁরা এ ফতোয়া জারি করেন।

ইউসুফ আল-কারযাভীর নেতৃত্বে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলারসের (আইইউএমএস) মহাসচিব আলী আল-কারদাঘি গতকাল সব মুসলিম দেশকে এই গণহত্যা এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে অবিলম্বে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৫ দফা সংবলিত ওই ফরমানে আলী আর কারদাঘি বলেন, ‘গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে আরব ও ইসলামিক সরকারগুলো ব্যর্থ হলে তা ইসলামিক আইন অনুযায়ী আমাদের নিপীড়িত ফিলিস্তিনি ভাইদের বিরুদ্ধে বড় অপরাধ বলে গণ্য হবে।’ কারদাঘি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সম্মানিত ধর্মীয় নেতাদের একজন। তাঁর ফরমান বা ফতোয়াগুলো বিশ্বের ১৭০ কোটি সুন্নি মুসলমানের কাছে উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব বহন করে।

কারদাঘি বলেন, ‘গাজার মুসলমানদের নির্মূলে কাজ করা কাফের শত্রুকে [ইসরায়েল] সমর্থন করা নিষিদ্ধ, তা সে যে ধরনের সমর্থনই হোক না কেন।’ তিনি আরও বলেন, এদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা অথবা স্থল, জল বা আকাশপথে সুয়েজ খাল, বাব এল-মান্দেব ও হরমুজ প্রণালির মতো আন্তর্জাতিক জলসীমা বা বন্দরের মাধ্যমে তাদের পরিবহনকে সহায়তা করা নিষিদ্ধ।

এই ধর্মীয় নেতা বলেন, ‘গাজায় আমাদের ভাইদের সহায়তার লক্ষ্যে দখলদার শত্রুদের স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে অবরুদ্ধ করার দাবি জানিয়ে কমিটি (আইইউএমএস) একটি ফতোয়া জারি করেছে।’ কারদাঘির বিবৃতির প্রতি অন্য আরও ১৪ জন মুসলিম পণ্ডিত সমর্থন জানিয়েছেন। ওই বিবৃতিতে বিশ্বের সব মুসলিম দেশের প্রতি তাদের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তিগুলো পর্যালোচনা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে তিনি আগ্রাসন বন্ধে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করেন।


সরাসরি উৎস সমূহ:

১। আজকের পত্রিকা (২২ ডিসেম্বর, ২০২৩)

২। সময় নিউজ (৮ এপ্রিল, ২০২৫)

৩। প্রথমআলো (৬ এপ্রিল, ২০২৫)

৪। দ্যা ডেইলি সান (৫ এপ্রিল, ২০২৫)

৫। ইসলামিক রিপাবলিক নিউজ এজেন্সি (৫ এপ্রিল, ২০২৫)

৬। ইন্ডিয়া টাইমস (৬ এপ্রিল, ২০২৫)

৭। বিবিসি (৮ নভেম্বর, ২০২৪)

৯। ইনকিলাব (১২ নভেম্বর ২০২৩)

১০। কালের কণ্ঠ (৯ এপ্রিল, ২০২৫)

১১। মিডল ইস্ট আই (৪ এপ্রিল, ২০২৫)

১৩। ভয়েস অফ আমেরিকা (১৩ নভেম্বর, ২০২৩)

১৪: জার্নাল আর্টিকেল (৪ এপ্রিল, ২০২৪), ফতোয়া নং-৮৩, ২০২৩ ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন সম্পর্কিত আইন। ইন্দোনেশিয়া উলামা কাউন্সিল।

Title