ভারতের ব্যবসায় আধিপত্যবাদের নেপথ্যে ইসরায়েলি নীতি বাস্তবায়ন
পলিসি বিশ্লেষণ
ভারত বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। দেশটির ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ধরন, নীতি এবং আন্তর্জাতিক সংযোগগুলোর মধ্যে ইসরায়েলি পলিসির প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে পরিলক্ষিত হয়। ভারত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি ও ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ বাজার। ইসরায়েল ভারতকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ অঞ্চলে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি তৈরি করেছে। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান, উন্নত বন্দর সুবিধা এবং বৃহৎ ভোক্তা বাজার দক্ষিণ এশিয়ায় ইসরায়েলের কার্যক্রম পরিচালনার একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো ভারতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, কৃষি ও সাইবার নিরাপত্তার মতো খাতে নিজেদের উপস্থিতি শক্তিশালী করেছে।
ভিডিও সূত্র: আনপ্যাকড ( ভারত ও ইসরায়েলের জটিল ইতিহাস)
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত দেশটির স্টার্টআপ কালচার এবং উচ্চতর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ভারতের ব্যবসায়িক খাতের সঙ্গে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ভারতের বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান যেমন টিসিএস, ইনফোসিস ও উইপরো ইসরায়েলের সাইবার নিরাপত্তা প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই সম্পর্ক ভারতের আইটি সেক্টরের গ্লোবাল আধিপত্যকে ত্বরান্বিত করেছে। তবে এর ফলে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
ভিডিও সূত্র: ব্রিফি (ভারত ইসরায়েলের প্রতি পাল্টা সম্মান প্রদর্শন করল)
ইসরায়েলি পলিসির কারণে ভারতের ব্যবসায় আধিপত্যবাদ একটি দ্বিমুখী প্রভাব সৃষ্টি করেছে। একদিকে ভারতের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় ভারতে ইসরায়েল সরাসরি যুক্ত হচ্ছে। ইসরায়েলি প্রযুক্তি এবং নীতির প্রতি নির্ভরশীলতা ভারতের বাজারকে বহুজাতিক কর্পোরেশনের কাছে আরও উন্মুক্ত করে তুলেছে। এটি দেশের অর্থনৈতিক অসমতা বৃদ্ধি করছে এবং একটি সীমিত গোষ্ঠীর হাতে শক্তি এবং সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে। ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো ভারতের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে যৌথ উদ্যোগ এবং অংশীদারিত্বের কৌশল গ্রহণ করেছে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা তাদের অন্যতম কার্যকর উপায়। এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে তারা ভারতের বাজারে দ্রুত প্রবেশ করছে এবং স্থানীয় ব্যবসার সঙ্গে তাদের প্রযুক্তি ও দক্ষতা ভাগাভাগি করছে উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলের ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (আইএআই)। ভারতের প্রতিরক্ষা সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে উন্নত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন করছে।
ভিডিও সূত্র: আলজাজিরা (ভারত কীভাবে ইসরায়েলের গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কভার করছে, দ্য লিসনিং পোস্ট)
ভারতীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদন শিল্পে ইসরায়েলের সহযোগিতা এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইসরায়েলের উন্নত প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণে বিশেষ দক্ষতা ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, এবং মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের অত্যাধুনিক সমাধান ভারতীয় বাজারে খাদ্যপণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতা ত্বরান্বিত করছে। ইসরায়েল তাদের খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি দিয়ে ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে সাহায্য করছে। বিশেষত, প্যাকেজিং প্রযুক্তি এবং স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থা খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াকরণকে আরও দ্রুত এবং দক্ষ করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি প্যাকেজিং প্রযুক্তি ভারতীয় স্ন্যাকস এবং পানীয় প্রস্তুতকারকদের জন্য খাদ্য সংরক্ষণকাল বাড়ানোর সমাধান দিচ্ছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে খাদ্যপণ্য পরিবহন এবং রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে।
ভিডিও সুত্র: বিহাইন্ড এশিয়া (ভারত কীভাবে ইসরায়েলের বৃহত্তম কোম্পানিগুলি অধিগ্রহণ করছে)
খাদ্য সংরক্ষণ এবং বর্জ্য হ্রাসের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি উদ্ভাবন ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। ইসরায়েলি ঠান্ডা চেইন ম্যানেজমেন্ট এবং বুদ্ধিমান সংরক্ষণ প্রযুক্তি ভারতীয় খাদ্য সংরক্ষণ খাতের একটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় ডেইরি এবং প্রক্রিয়াজাত মাছ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের তাজা গুণমান দীর্ঘদিন ধরে বজায় রাখতে পারছে। ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো ভারতীয় খাদ্য উৎপাদকদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর খাদ্যপণ্য তৈরিতে সহায়তা করছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি খাদ্য প্রযুক্তি সংস্থা বিশেষভাবে প্রোটিন সমৃদ্ধ এবং লো-ক্যালোরি স্ন্যাকস তৈরিতে ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে সাহায্য করছে। এই উদ্ভাবনগুলো শহুরে ভোক্তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যারা স্বাস্থ্যকর খাদ্যের দিকে ঝুঁকছে।
ইসরায়েলের অটোমেশন প্রযুক্তি এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স খাদ্য উৎপাদন খাতকে আরও গতিশীল করে তুলেছে। ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো ভারতের খাদ্যপ্রস্তুতকারকদের জন্য অটোমেটেড মেশিনারি এবং ডেটা-চালিত উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু করেছে। এর ফলে খাদ্য উৎপাদনের খরচ কমেছে এবং উৎপাদনের মান উন্নত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারতীয় রুটি এবং প্যাস্ট্রি প্রস্তুতকারকরা তাদের উৎপাদনকে আরও দ্রুত ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করছে। ইসরায়েলি মান নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভারতীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদনে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সাহায্য করছে। ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোর দ্বারা সরবরাহকৃত ফুড টেস্টিং কিট এবং আইওটি-ভিত্তিক মান নিয়ন্ত্রণ সরঞ্জাম ভারতীয় কোম্পানিগুলোর খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি প্রযুক্তি মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্যের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য দূষণ সনাক্ত করতে সহায়তা করছে, যা ভারতীয় বাজারে খাদ্য নিরাপত্তার মান বৃদ্ধি করেছে।
ভিডিও সুত্র: বিজনেস টুডে (ইসরায়েলে একাধিক বড় ভারতীয় বিনিয়োগ, ২৩ বছরে ভারতীয় কর্পোরেটদের দ্বারা $৩৮৩ মিলিয়ন বিনিয়োগ)
উন্নত পণ্য এবং সেবা প্রদান ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোর বাজার দখলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। তারা তাদের উচ্চমানের পণ্য এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলের সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি চেক পয়েন্ট সফটওয়্যার টেকনোলজিস ভারতীয় কর্পোরেট এবং সরকারি সংস্থাগুলোর জন্য উন্নত সাইবার সুরক্ষা সেবা প্রদান করছে। এই উন্নত প্রযুক্তি কেবল গ্রাহকদের সুরক্ষাই নিশ্চিত করছে না, বরং স্থানীয় প্রতিযোগীদের তুলনায় ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
ভিডিও সুত্র: এএনআই নিউজ (ইসরায়েল বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলির জন্য ভারতীয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোম্পানির সহযেোগীতা)
এছাড়া, ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো স্থানীয় চাহিদার সঙ্গে মানানসই পণ্য এবং সেবা প্রদানেও দক্ষ। তাদের পণ্যগুলো বিশেষায়িত এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য তৈরি, যা বাজারের উচ্চমানের গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে। যেমন, মোবিলআই তাদের ড্রাইভার অ্যাসিস্ট্যান্স সিস্টেম ভারতের যানজটপূর্ণ রাস্তায় চালকদের জন্য মানানসই করে তুলেছে। এই ধরনের পণ্য এবং সেবার মাধ্যমে ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো শুধু ব্যবসায়িক সফলতাই অর্জন করছে না, বরং বাজারে দীর্ঘমেয়াদী অবস্থানও নিশ্চিত করছে। এই কৌশলগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো ভারতের বাজারে তাদের আধিপত্য বিস্তার করছে। তবে এর ফলে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাগুলো প্রতিযোগিতার বাইরে চলে যাচ্ছে এবং স্থানীয় প্রযুক্তি উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই ভারতের জন্য প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি, যা বিদেশি সহযোগিতার সুফল গ্রহণের পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাকে সুরক্ষিত করেছে।
ভিডিও সুত্র: অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন ( ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক: অভিন্ন ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে ইচ্ছুক নেতানিয়াহু)