Title Title

ইসরায়েল প্রভাবিত ভারতীয় অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন ক্রেতার বিশ্বাস অর্জনে সফল

তুলনামূলক বিশ্লেষণ

অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন হলো এমন বিজ্ঞাপন যা কোনো পণ্য, সেবা বা প্রতিষ্ঠানের বাস্তব তথ্যকে অতিরঞ্জিত করে বা অসত্য উপস্থাপন করে। এর উদ্দেশ্য সাধারণত ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা এবং তাদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলা। এই ধরনের ইসরায়েল প্রভাবিত ভারতীয় বিজ্ঞাপন বিভিন্ন প্রকার হতে পারে এবং এর মাধ্যমে ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করা হয় বা তাদের নিকট অপ্রাসঙ্গিক বা ভুল তথ্য প্রদান করা হয়।
ভারতীয় অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পণ্য বা সেবার কার্যকারিতা এবং গুণমান সম্পর্কে অবাস্তব দাবি করা। এই ধরনের দাবি সাধারণত এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে গ্রাহকরা সহজেই প্রভাবিত হন এবং পণ্যটি কিনতে আগ্রহী হন। ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা দ্বারা পণ্যের এমনভাবে বিজ্ঞাপন তৈরি করে পণ্যমান এ ধরনের দাবি বাস্তবায়নযোগ্য নয় বা সম্পূর্ণ অসত্য। বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবাস্তব দাবি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতার আবেগকে উসকে দেয় এবং তারা ভাবতে শুরু করেন যে পণ্যটি তাদের সমস্যার অবিশ্বাস্য সমাধান দিতে পারবে। এই ধরনের দাবির পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বা যৌক্তিক ভিত্তি থাকে না, যা ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি কোম্পানি ইউনিলিভারের ব্র্যান্ড ফেয়ার এন্ড লাভলী (বর্তমানে গ্লু এন্ড লাভলি) এর একটি প্রসাধনী পণ্যের বিজ্ঞাপনে বলা হতে পারে, ‘মাত্র ৬ সপ্তাহে আপনার হাত মুখের মতো ফর্সা ও উজ্জ্বল হবে’ বাস্তবে এটি অসম্ভব এবং কোনো প্রসাধনী পণ্য এত দ্রুত ত্বকের স্বাভাবিক গঠন পরিবর্তন করতে পারে না।

ফেয়ার এন্ড লাভলী (বর্তমানে গ্লু এন্ড লাভলি) বিজ্ঞাপন

আরেকটি উদাহরণ হতে পারে ত্বক দুধের মতোা ফর্সা করার ক্ষেত্রে, যেখানে দাবি করা হয়, ‘ক্রিম মুখের গভীরে প্রবেশ করে কালোদাগ দুর করে’ বাস্তবে এত দ্রুত কি ধরণের দাগ দুর করতে সক্ষম নয়, তবে এমন দাবি মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। এই ধরনের অবাস্তব দাবি পণ্যের প্রতি কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে এবং অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকদের আর্থিক এবং শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় নায়ক-নায়িকা দ্বারা অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো অপ্রমাণিত তথ্য ব্যবহার করা। এই ধরনের ইসরায়েল প্রভাবিত বিজ্ঞাপনপণ্য বা সেবার কার্যকারিতা এবং উপযোগিতার সম্পর্কে এমন কিছু দাবি করে, যা কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ, গবেষণা বা নির্ভরযোগ্য উৎস দ্বারা সমর্থিত নয়। এই ধরনের অপ্রমাণিত তথ্য ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করার জন্য এবং তাদের মনে পণ্যের প্রতি একটি ভুল ধারণা তৈরি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।

ফেয়ার এন্ড লাভলী (বর্তমানে গ্লু এন্ড লাভলি) বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপনে যখন অপ্রমাণিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়, তখন তা এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে ক্রেতারা পণ্যের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন না তোলে। কিছু পণ্যের উদ্দেশ্য প্রণোদিত গবেষণার মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে দেখানো হয় যে পণ্যের উপাদান ত্বকের জন্য অত্যন্ত কার্যকরি। অথচ, পিয়ার রিভিউ জার্নাল ছাড়া ও মেডিক্যাল ট্রায়াল ব্যতীত কোন গবেষণার তেমন ভিত্তি নেই।  উদাহরণস্বরূপ, ইউনিলিভারের গ্লু এন্ড লাভলী ক্রিমের বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘ত্বকের ৩ স্তরের গভীরে গিয়ে ৪০% ত্বকের দেয় উজ্জ্বলতা’ পণ্যটি নাকি আগের চেয়ে অনেক এডভান্স বিষয়ে টিভিসি প্রচার করছে এই দাবির পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যেমন প্রশ্নবিদ্ধ তেমনি পুনঃগবেষণার প্রয়োজন পড়ে।

ফেয়ার এন্ড লাভলী (বর্তমানে গ্লু এন্ড লাভলি) বিজ্ঞাপন

কেবল এরূপ বিজ্ঞাপন অনুন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশে বেশিকরে প্রচার করে, এমন বিজ্ঞাপন  ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য ব্যবহার করা হয়। আরেকটি উদাহরণ হতে পারে ইউনিলিভারের হরলিক্স নিয়ে আশির দশকের স্বাস্থ্য সাপ্লিমেন্টের বিজ্ঞাপনে বলা, ‘একজন ডাক্তারের হরলিক্স খাওয়ার পরামর্শ দিতে দেখা যায় এবং পরম পুষ্টিদাতা হিসেবে ট্যাগ লাগানো হয়’ এ ধরনের তথ্য সাধারণত সুনির্দিষ্ট গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় না, বরং ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য অতিরঞ্জিত করা হয়।

একটি হরলিক্স বিজ্ঞাপন

আধুনিক সময়ে সোশাল মিডিয়া নির্ভর ভারতীয় বিজ্ঞাপন বাংলাদেশে প্রচারণা চালানো হয়, এটি অবৈধ এআই নির্ভর বিজ্ঞাপন, যা মানুষের আবেগকে কাজে লাগানো। এই ধরনের বিজ্ঞাপন মানুষের অনুভূতি, ভয়, আকাঙ্ক্ষা বা উচ্চাশার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এটি বিশেষত এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে গ্রাহকরা পণ্যটি কিনতে বাধ্য হন, কারণ তাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে পণ্যটি তাদের জীবনের কোনো বিশেষ চাহিদা বা সমস্যা সমাধান করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি হরলিক্স  শিশুখাদ্য পণ্যের বিজ্ঞাপনে বলা হতে পারে, ‘বচ্চাদের লম্বা, শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান করে তোলে’ এটি বাবা-মায়েদের মধ্যে এমন একধরনের ভয় তৈরি করে যে যদি তারা এই পণ্যটি না কেনেন, তবে তাদের সন্তান পুষ্টি বা সঠিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

একটি আধুনিক হরলিক্স বিজ্ঞাপন

ভেজাল তথ্য হলো এমন তথ্য যা সত্যকে বিকৃত করে বা আংশিকভাবে সঠিক তথ্য দিয়ে ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করার জন্য উপস্থাপন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি নির্দিষ্ট ইসরায়েলি ব্র্যান্ডের টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘৩০ সেকেন্ডে দাঁতের শিরশির অনুভূতি থেকে মুক্তি দেয় ও ফিরে আসা বন্ধ করে, অন্য ব্র্যান্ডগুলো দাঁতের ক্ষতি করে।’ এ ধরনের দাবি সাধারণত কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণা বা প্রমাণের ভিত্তিতে করা হয় না এবং অন্য ব্র্যান্ডের সুনাম ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়।

একটি পেপসোডেন্ট ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন

ইসরায়েল প্রভাবিত ভারতীয় অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপনী প্রচারণা ক্রেতাদের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে, বিজ্ঞাপনগুলো সাধারণত পণ্যের গুণমান বা কার্যকারিতার অসত্য দাবির মাধ্যমে ক্রেতাদের প্রভাবিত করে, যা অনেক সময় তাদের জন্য বিভ্রান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। ক্রেতারা বিজ্ঞাপনের আকর্ষণীয় বার্তা দেখে পণ্য কিনলেও, বাস্তবে তারা প্রাপ্ত সেবার মান এবং বিজ্ঞাপনে দেখানো গুণাবলীর মধ্যে বড় ধরনের ফারাক দেখতে পান। এসব ভারতীয় বিজ্ঞাপনে প্রদত্ত ভুয়া বা অতিরঞ্জিত তথ্যের ভিত্তিতে পণ্য কিনতে আগ্রহী হন, যা তাদের নির্ধারিত বাজেটের বাইরে গিয়ে খরচ করতে বাধ্য করে। তবে পণ্যটি বিজ্ঞাপিত মান অনুযায়ী কাজ না করলে তারা হতাশ হন এবং তাদের আর্থিক ক্ষতি হয়। বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে ক্রেতারা তাদের প্রয়োজনীয় সেবা বা পণ্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেন না। অনেক সময় বিকল্প পণ্য বা সেবার প্রকৃত সুবিধা থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে যায়। ফলে তারা এমন পণ্য বা সেবায় বিনিয়োগ বা ক্রয় করেন, যা তাদের প্রকৃত প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম। স্থানীয় পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা ফিরে আনার জন্য প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো পণ্যের মান উন্নত করা। স্থানীয় পণ্যগুলোকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তুলনীয় করে তোলা প্রয়োজন। পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গুণগত মানের নিশ্চয়তা এবং সঠিক উপাদানের ব্যবহার ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে সহায়তা করে। ক্রেতারা যখন দেখবেন যে স্থানীয় পণ্য তাদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম, তখন তাদের মনোভাব ইতিবাচক হবে। স্থানীয় পণ্য সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল, যেমন মোড়কে ‘বাংলাদেশী পণ্য’ ট্যাগ লেখা যেতে পারে। পণ্যগুলোর স্থানীয় উৎপাদন প্রক্রিয়া, উপকরণ এবং তাদের স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান সম্পর্কে ক্রেতাদের জানানো উচিত। এটি ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয় পণ্য কেনার জন্য একধরনের গর্ব এবং দায়বদ্ধতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। স্থানীয় পণ্যের মূল্য-মানের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক পণ্যের তুলনায় স্থানীয় পণ্য সাশ্রয়ী হলে ক্রেতারা তাদের পছন্দের তালিকায় রাখবে।
লেখক: প্রধান স্বেচ্ছাসেবক সমন্বয়ক, ভয়েস অফ বয়কট

গ্রন্থপঞ্জি
১. আহমেদ, ক. (২০১৮)। স্থানীয় পণ্যের মান বৃদ্ধি এবং আস্থা ফিরিয়ে আনার
কৌশল। ঢাকা: বাংলাদেশ পাবলিকেশন লিমিটেড।
২. রহমান, ম. (২০১৯)। স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতা এবং ব্র্যান্ডের অবস্থান।
বাংলাদেশ বিজনেস রিভিউ, ১৫(২), ১২-১৮।
৩. হোসেন, র. (২০২০)। স্থানীয় উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বাংলাদেশ
ইকোনোমিক জার্নাল, ২২(৪), ৫৫-৬৫।
৪. চৌধুরী, স. (২০১৭)। ক্রেতার আস্থা এবং বিজ্ঞাপনের প্রভাব। কমিউনিকেশন
স্টাডিজ, ১০(১), ২৫-৩২।
৫. করিম, ন. (২০১৬)। স্থানীয় পণ্যের প্রচার কৌশল: একটি পর্যালোচনা। বিপণন
ও পরিচালনা, ১৩(৩), ৪৫-৫৮।
৬. ইসলাম, জ. (২০১৮)। আস্থাহীন ক্রেতার মনস্তত্ত্ব। মনস্তত্ত্ব ও সমাজ, ৭(১),
৩৩-৪৫।
৭. বেগম, স. (২০২১)। মিথ্যা বিজ্ঞাপনের প্রভাব এবং ক্রেতার সাড়া। বিজ্ঞাপন
বিশ্লেষণ, ১৮(২), ৫৫-৬২।
৮. খান, এ. (২০১৫)। আন্তর্জাতিক পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতা: স্থানীয় উদ্যোগের
ভূমিকা। ঢাকা: বিজনেস বুকস।
৯. মজুমদার, প. (২০১৯)। স্থানীয় পণ্য উৎপাদন ও এর চ্যালেঞ্জ। ইকোনোমিক
স্টাডিজ রিভিউ, ২১(২), ৪২-৫০।
১০. সুলতানা, র. (২০২০)। স্থানীয় ব্র্যান্ডের প্রচারণা: সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা।
বাংলাদেশ বিজনেস জার্নাল, ১৬(১), ৭৫-৮২।
১১. শিকদার, এ. (২০১৮)। স্থানীয় পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি। বাজার
বিশ্লেষণ, ১৪(৪), ৯০-১০২।
১২. চক্রবর্তী, ক. (২০১৭)। আস্থা ফেরানোর মনস্তাত্ত্বিক দিক। মনোবিজ্ঞান রিভিউ,
৮(৩), ৩৫-৪২।
১৩. আলম, জ. (২০১৯)। স্থানীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনে সত্যনিষ্ঠতা। বিজ্ঞাপন ও
বিপণন, ২০(২), ৬৫-৭২।
১৪. রহমান, স. (২০২১)। আস্থা এবং বাজার কৌশল। কমিউনিকেশন জার্নাল,
১১(২), ৪৫-৫৫।
১৫. হাসান, ক. (২০১৬)। স্থানীয় পণ্য উৎপাদনে উদ্ভাবনী কৌশল। ঢাকা:
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি প্রেস।
১৬. খান, র. (২০২০)। মিথ্যা বিজ্ঞাপন এবং আইনগত প্রতিকার। আইন ও সমাজ,
১০(১), ৫৫-৬৫।
১৭. রহমান, জ. (২০১৮)। স্থানীয় পণ্য এবং গ্রাহক চাহিদা। বাজার গবেষণা, ১৫(৩),
৭৫-৮৫।
১৮. নাসির, স. (২০১৯)। বিজ্ঞাপনে অতিরঞ্জন এবং এর প্রভাব। বিপণন বিশ্লেষণ,
১৩(২), ৪৫-৫২।
১৯. কাদের, ম. (২০২০)। স্থানীয় পণ্য এবং সামাজিক সচেতনতা। সামাজিক
গবেষণা রিভিউ, ১৯(১), ৩০-৪০।

Title