বাংলাদেশের সংবাদপত্রে ভারতীয় সংস্কৃতির আদিপত্য
পর্যবেক্ষণ জরিপ
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতির আদিপত্য বর্তমানে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। দেশের সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, ভারতীয় বিজ্ঞাপন প্রচারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার, এমনকি চলচ্চিত্র এবং নাট্যজগতেও ভারতীয় সংস্কৃতি বিস্তৃতভাবে প্রচারিত হচ্ছে। এ প্রভাব শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আমাদের স্থানীয় সংস্কৃতি এবং সামাজিক কাঠামোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য থাকলেও, ভারতীয় সংস্কৃতি প্রভাবিত চলচ্চিত্র, টিভি সিরিয়াল, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং গান ক্রমাগত সেই ঐতিহ্যকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের মাধ্যমে একটি বিদেশি জীবনধারা, ভাষা এবং আচার-আচরণ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। এই প্রভাব নতুন প্রজন্মের মধ্যে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে এবং ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে।
গণমাধ্যমে ভারতীয় অনুষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপন প্রচার এতটাই প্রচলিত যে অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় শিল্পীরা পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছেন না। তাছাড়া, ভারতীয় কনটেন্টের নিম্নমানের অনেক বার্তাও সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে, ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর অবাস্তব কাহিনি এবং অস্বাভাবিক পারিবারিক দ্বন্দ্ব আমাদের সমাজে পারিবারিক মূল্যবোধের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
ভয়েস অফ বয়কট মোট ৯ টি বাংলাদেশের প্রথমসারির ইংরেজি বাংলা মাধ্যমের সংবাদপত্রসমূহের একটি গভীর পর্যবেক্ষণমূলক জরিপ করেছেন, জরিপের সময়কাল এপ্রিল ও নভেম্বর ২০২৪ (মোট ৬০দিন) উাপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রথম আলো পত্রিকার বিনোদন পাতায় নিয়মিত ভারতীয় শোবিজের নূন্যতম ১টি কনটেন্ট ছাপিয়েছেন। যা দেশীয় সংস্কৃতির জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এসব কনটেন্ট শুধু ভারতীয় তারকাদের গ্ল্যামার আর ব্যক্তিগত জীবনের গল্প তুলে ধরেই থেমে থাকে না; বরং বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে তাদের প্রতি অতি নির্ভরশীল করে তোলে। পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে বলিউড-ঢালিউড ট্যাগে আলদা প্রতিবেদন প্রচার করা হয়, ফলে স্থানীয় শিল্পী এবং কনটেন্ট নির্মাতারা প্রচারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছেন। যদিও পত্রিকাটির ঢালিউড ও হলিউড ট্যাগে অপর্যান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রিন্ট মিডিয়া দ্বারা ভারতীয় সংস্কৃতির এই একচ্ছত্র প্রভাব আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জায়গা সংকুচিত করছে।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় যুগান্তর পত্রিকায় নিয়মিত ভারতীয় বিনোদনমূলক প্রতিবেদন কনটেন্ট প্রচার দেশের সংস্কৃতির জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। প্রথমআলো’র অনলাইন সংস্করণের যুগান্তর ট্যাাগ ব্যবহার করলেও তাদের নিউজ পোর্টালে ভারতীয় সিনেমা, টিভি সিরিয়াল ও তারকাদের খবর স্থানীয় শিল্পীদের থেকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, যা তরুণ সমাজকে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহহীন করে তুলছে। এছাড়া, ভারতীয় কনটেন্টে অতি-নাটকীয়তা এবং অপ্রাসঙ্গিক বার্তা পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ইংরেজ ডেইলি সান পত্রিকার অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিনোদন বিভাগে ভারতীয় প্রতিবেদন প্রাধান্য বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিকৃতির জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়মিত ভারতীয় সিনেমা, সিরিয়াল এবং তারকাদের খবর প্রকাশ করে পত্রিকাটি দেশীয় শিল্প ও সংস্কৃতিকে পিছনের সারিতে ঠেলে দিচ্ছে। ডেইলি সানের উচিত স্থানীয় সংস্কৃতি ও শিল্পীদের ওপর বেশি জোর দিয়ে, দেশীয় কনটেন্টকে প্রাধান্য দেওয়া এবং সাংস্কৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা।
মানবজমিন পত্রিকার বিনোদন বিভাগে ভারতীয় প্রতিবেদন প্রচার বাংলাদেশি সংস্কৃতির জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নিয়মিতভাবে ভারতীয় সিনেমা, সিরিয়াল এবং তারকাদের খবর প্রকাশ দেশীয় শিল্প ও সংস্কৃতির গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম এই বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা স্থানীয় কনটেন্টের প্রতি তাদের আগ্রহ কমাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশি শিল্পীরা তাদের কাজের স্বীকৃতি এবং প্রচারের সুযোগ হারাচ্ছেন। ভারতীয় সিরিয়াল ও চলচ্চিত্রের অপ্রাসঙ্গিক বার্তা এবং অতিরঞ্জিত কাহিনি আমাদের সমাজের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মানবজমিনের উচিত দেশীয় শিল্প ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করা।
জনকণ্ঠ পত্রিকার বিনোদন বিভাগে ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং বিনোদন সংক্রান্ত কনটেন্টের নিয়মিত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ভারতীয় সিনেমা ও তারকাদের খবর স্থানীয় শিল্প ও কনটেন্টের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পাওয়ায় বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অবহেলিত হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে স্থানীয় শিল্পীদের অবমূল্যায়ন করছে। তাছাড়া, ভারতীয় কনটেন্টের অতিনাটকীয় এবং বাস্তবতা-বিচ্যুত গল্প সমাজের মূল্যবোধ ও জীবনধারায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
নয়াদিগন্ত পত্রিকার অনলাইন পোর্টালের সিনেমা বিভাগে অতিরিক্ত ভারতীয় বিনোদন প্রচার বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ভাষার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। নিয়মিতভাবে ভারতীয় সিনেমা, তারকাদের খবর এবং ট্রেন্ড প্রচার দেশীয় ভাষা ও শিল্পকে কোণঠাসা করে দিচ্ছে। এর ফলে তরুণ প্রজন্ম ভারতীয় ভাষা, বিশেষত হিন্দি ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ছে। ভারতীয় কনটেন্টে ব্যবহৃত ভাষা ও জীবনধারা স্থানীয় ভাষা এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংঘাত তৈরি করছে। নয়াদিগন্তের উচিত স্থানীয় চলচ্চিত্রকে গুরুত্ব প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষার জন্য ভূমিকা রাখা।
অনলাইনে জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকার বিনোদন বিভাগে ভারতীয় শিল্পীদের সংস্কৃতির প্রচার বাংলাদেশের ভাষা’র বিকৃতি ঘটাচ্ছে। পত্রিকাটির ভারতীয় নায়ক-নায়িকাদের গল্পনির্ভর প্রতিবেদন স্বদেশের জীবনধারা এবং সামাজিক বার্তা আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলা ট্রিবিউনের উচিত দেশীয় শিল্পী ও কনটেন্টকে প্রাধান্য দিয়ে, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা। এ ভারসাম্যহীনতা সংস্কৃতির গভীর সংকট ডেকে আনতে পারে।
ইংরেজি ডেইলি অবজার্ভার পত্রিকার বিনোদন বিভাগে ভারতীয় কনটেন্টের অতিরিক্ত প্রচার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তরুণ প্রজন্ম ভারতীয় সংস্কৃতি ও হিন্দি ভাষার প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ছে, যা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার শোবিজ পাতায় ভারতীয় প্রতিবেদন নিয়মিত ১টি হলেও প্রচার করে, যা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য একটি বড় হুমকি। এ ধরনের ভারতীয় প্রতিবেদন তৈরি স্থানীয় সংস্কৃতি বিকৃতির পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ডেইলি স্টার পত্রিকার বিনোদন ও সংস্কৃতির আলাদা ২টি বিভাগ থাকলেও ভারতীয় কনটেন্ট তুলনামূলকভাবে কম প্রচারিত হয়, যা একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। অন্য পত্রিকাগুলোর মতো ভারতীয় সিনেমা ও তারকাদের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল না হয়ে ডেইলি স্টার স্থানীয় ও বৈশ্বিক কনটেন্টের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। এ ধরনের নীতি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক। তবে, সীমিত হলেও ভারতীয় কনটেন্টের প্রভাব এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এমন প্রচার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বাড়াতে পারে। ডেইলি স্টারের এই ভারসাম্য রক্ষা করে স্থানীয় শিল্প ও কনটেন্টকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া দেশের সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য কার্যকর হতে পারে।
সংবাদপত্রগুলোর বাংলাদেশের নিজস্ব কনটেন্ট তৈরির প্রতি আরও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। স্থানীয় আগত শিল্পীদের পরিচায়নে প্রতিবেদন, দেশীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং সংবাদপত্রে প্রচারিত কনটেন্টের মান নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, জনগণকেও তাদের বিনোদন চাহিদার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। সর্বশেষে, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব না হলেও, আমাদের সংস্কৃতির মৌলিকত্ব এবং ঐতিহ্য রক্ষার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। তাই গণমাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।